সামাজিক মাধ্যম যেন আজকাল মনের আয়না হয়ে উঠেছে। নেটিজেনদের সুখ-দুঃখ, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির ছাপ পড়ে এখানে। সাধারণ থেকে অসাধারণ কেউ এর বাইরে নন। এই যেমন অভিনেত্রী নিদ্রা দে নেহা সম্প্রতি ফেসবুকে কিছু অভিযোগ তুলেছেন। একইসঙ্গে ছেড়ে দিতে চেয়েছেন অভিনয়।
পোস্টটি সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনার জ্বালানীর যোগান দিচ্ছে। কেউ কেউ নড়েচড়ে বসেছেন। আবার কেউ নিজের মতো করে দিচ্ছেন ব্যাখ্যা। বিস্তারিত জানতে যোগাযোগ করা হয় এ অভিনেত্রীর সঙ্গে।
শুরুতেই নিদ্রা নেহা বলেন, ‘আমি নিজের যোগ্যতায় মিডিয়ায় এসেছি। মিস ইউনিভার্সে অসংখ্য প্রতিযোগীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে, পুরস্কার নিয়ে বের হয়েছি। এরপর বাংলাদেশের বড় বড় সব ব্র্যান্ডের সঙ্গে কাজ করেছি। নিজেকে মডেল হিসেবে তৈরির জন্য যা যা প্রয়োজন করেছি। এরপর মনে হলো আমি ভিজ্যুয়ালে যাব। সেজন্য অভিনয় শেখা প্রয়োজন। কিন্তু অভিনয়ের ওপর আমার কোনো প্রশিক্ষণ নেই। নিজেকে প্রস্তুত করতে তখন প্রাচ্যনাট্যে যোগ দিই। সেখান থেকে শিখে অভিনয় শুরু করি। আমার প্রথম কাজ ছিল মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সঙ্গে। ওনার সঙ্গে আমি ৩০ দিন ছিলাম। এটা আমার কাছে বিশাল বড় গ্রুমিং। তারপর থেকে যতগুলো কাজ করেছি সব বড় বড় টিমের সঙ্গে। আমার সঙ্গে যে অভিনয়শিল্পীরা কাজ করেছেন প্রত্যেকে শিক্ষিত। সঠিক পদ্ধতিতে কাজ করেন। আমিও সেভাবেই কাজ করি।’
এরপর বলেন, ‘খেয়াল করলে দেখবেন আমার কাজের সংখ্যা কম কিন্তু যেকটা করেছি সবগুলো গুণগত মানসম্পন্ন। একজন অভিনয়শিল্পী কেমন অভিনয় করে তার কাজই বলে দেয়। উদাহরণস্বরুপ ওয়েব সিরিজ ‘আধুনিক বাংলা হোটেল’-এর ‘হাসের সালুন’-র কথা বলি। সেখানে আমার চরিত্রের দৈর্ঘ্য কম। কিন্তু ১০ মিনিটের ওই কাজের জন্য বিদেশি গণমাধ্যমে পর্যন্ত আমাকে নিয়ে লেখালেখি হয়েছে। এরপর আমি পাওলি দামের সঙ্গে একটি কাজ করলাম। সামনে স্বস্তিকা মুখার্জির সঙ্গে কাজের কথা। যারা আমাকে কাজের জন্য ডাকছেন বা ডেকেছেন আমি মনে করি তাদের ডাক মানেই তো আমার জন্য একটি সার্টিফিকেশন। কোয়ালিটি না থাকলে তো তারা ডাকতেন না। যে কারণে আমি বলতে গেলে ভেঙেই পড়েছি। রাগ, ক্ষোভ, কষ্ট— যে কারণেই হোক স্ট্যাটাস দিয়েছি।’
নিদ্রা নেহা জানালেন, ফেসবুকে উগরে দেওয়া তার এই ক্ষোভ নির্দিষ্ট একটি প্রজেক্টের কারণে না। একাধিকবার তার সঙ্গে অবিচার করা হয়েছে। তবে কোনো প্রজেক্টের নাম উল্লেখ করতে ইচ্ছুক নন তিনি। বললেন, ‘এবারই প্রথম না। বেশ কয়েকবার আমার সঙ্গে এরকম হয়েছে। এর আগে আরও একটি প্রজেক্ট নিয়ে কথা হয়েছিল। সেখানে বাংলাদেশের বড় একজন পরিচালক ছিলেন। যিনি অভিনেতা তিনি ছোট পর্দায় কাজ করতেন। এখন বড় পর্দায় করছেন। ওনার সঙ্গে আমার একটি কাজ হওয়ার কথা ছিল। সেসময় আমার বাবার চিকিৎসা চলছিল। সেজন্য প্রজেক্টটি চূড়ান্ত করে আমি মুম্বাই যাই। এরপর একদিন হঠাৎ খবরে দেখলাম কাজটিতে অন্য এক নায়িকা। আমি পরিচালকের টিমের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তারা আমার কাছে সময় চাইলো। কিন্তু আমাকে নিয়ে তারা প্রযোজকের সঙ্গে ফাইট দিয়ে পারেননি। পরে আমাকে না করে দেওয়া হয়। আমিও মেনে নিই। এর ১০ দিন পর ফের আমার শিডিউল নেয় তারা। পরিচালক আমাকে নিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন। হয়তো চরিত্রটির জন্য আমাকে উপযুক্ত মনে করেছিলেন। কিন্তু প্রযোজকের অনিচ্ছায় রাখতে পারেননি।’
প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে নেহা বলেন, ‘আমার প্রশ্ন, এটা কেন শুটিংয়ের আগের দিন কিংবা দুইদিন আগে হবে? সবকিছু চূড়ান্ত হওয়ার পর কেন এরকম আচরণ?’
এবার সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনাটি বর্ণনা দেন নেহা। বলেন, ‘এখন যে প্রজেক্টটা নিয়ে কথা হচ্ছে সেটা নিয়ে বলি। অনেকে আমাকে ভুল বুঝছেন। সামাজিক মাধ্যমে কেউ কেউ মন্তব্য করছেন, ‘অডিশনে না টিকলে তো বাদ দেবেই।’ কিন্তু বিষয়টি অডিশনের না। আমি একদিন শুটিংও করেছি। আমার বাবা ক্যানসারের রোগী। চিকিৎসার জন্য তাকে মুম্বাই নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কাজটির জন্য আমি সব বাদ দিই। ফ্লাইটের টিকিট বাতিল করে তাদের মে পর্যন্ত টানা দুই মাসের ডেট দিই। ঈদের আগে একদিন শুটিংও করি। এরমধ্যে এক রিপোর্টার আমার কাছে নতুন কাজ সম্পর্কে জানতে চাইলে ছবিটির কথা বলি। এরপর নিউজ হলো। আমাকে নায়িকা বানিয়ে দেওয়া হলো। আমি তখনও নিউজটি দেখিনি। কিন্তু ছবি সংশ্লিষ্টরা মনে করলেন আমি নিউজ করিয়েছি। আমার সঙ্গে চেচামেচি করলেন। আমি বললাম, করাইনি। যেখান থেকে নিউজ করা হয়েছে সেখান থেকেও জানানো হলো আমি করাইনি।’
এদিকে অনেকের ধারণা নেহার অভিযোগের সঙ্গে ‘তাণ্ডব’ সিনেমার যোগ রয়েছে। দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাচ্ছেন কেউ কেউ। তবে অভিনেত্রী নাম উল্লেখে অনিচ্ছুক। নেহার কথায়, ‘দেখুন আমি যদি করিও তবুও তো তারা আমার সঙ্গে এরকম করতে পারেন না। কেননা আমাকে তো বলা হয়নি যে নিউজ করা যাবে না। সাধারণত কাজের ক্ষেত্রে টিম যদি কোনোকিছু গোপন রাখার প্রয়োজন বোধ করে তবে আর্টিস্টের সঙ্গে বসে আলোচনা করে। কিন্তু আমাকে এ ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। চুক্তিপত্রে সাইন করার কথা ছিল। হয়তো সেখানে লেখা থাকত। কিন্তু তাড়াহুড়া করে কাজটি শুরু করা হয়। সাইন করার সময়টা-ই ছিল না। ঈদের পর চুক্তিপত্রে স্বাক্ষরের কথা ছিল। এছাড়া তাদের পক্ষ থেকে কেউ আমাকে কাজটির কথা গোপন রাখতে বলেওনি।’
আরও বলেন, ‘যেদিন শুরু হবে সেদিন শুধু বলা হয়েছিল লুকের ছবি প্রকাশ করা যাবে না। আমি প্রকাশ করিনি। এ ঘটনার পর তাদের বলেছি যে আমাকে কি বলা উচিত ছিল না যে কাজটার কথা কাউকে বলা যাবে না। তাহলে আমার স্বামীকেও বলতাম না। তারা আমাকে বলে, বলার কি আছে! এটা তো কমন সেন্সের বিষয়।’
এবার নেহার অভিযোগ ও প্রশ্ন, ‘এটা কি অপেশাদারিত্ব নয়? একটা নিউজের জন্য আমাকে শুটিংয়ের আগের দিন ফোন দিয়ে বলছে, তোমার ক্যারেক্টার থাকবে না। এটা কি অনৈতিক না? একদিন শুটিংয়ের পর বাদ দেওয়া পুরোপুরি অবিচার। প্রজেক্ট হাজারটা আসবে। আমরা শিল্পীরা রিজেকশনের জন্য প্রস্তুত থাকি। কিন্তু কথা হচ্ছে চূড়ান্ত করার পর কেন বাদ দেবে। এর আগে যে প্রজেক্টর কথা বললাম সেটার জন্য আমি দুই মাস সময় দিয়েছি। এই ক্যারেক্টারের জন্য না খেয়ে ৫ দিনে ৩ কেজি ওজন কমিয়েছি। তারা আমার এই সময়গুলো নষ্ট করল। কেন করল।’
আক্ষেপের সুরে শরতের জবার অভিনেত্রী বলেন, ‘জীবনের প্রথম যখন নাটক করতে যাই তখনও এরকম হয়েছিল। সবকিছু ঠিকঠাক। আমার স্বামীও ছিল সে নাটকে। শুটিংয়ের আগের দিন আমাকে বলা হলো কাজটি হচ্ছে না। কিন্তু আমি তো জানি কাজটা হচ্ছে। কেননা আমার বরকে খুদে বার্তায় কল টাইম জানানো হয়েছে। পরে জানতে পারি, আমি নাকি প্রযোজকের সঙ্গে বেশি কথা বলিনি। আমি প্রযোজকের সঙ্গে কি কথা বলব। তাকে সালাম দিয়েছি, কুশলাদি বিনিময় করেছি। স্বাভাবিকভাবে যেটুকু বলা দরকার। এর বেশি আর কি কথা বলব!’
অভিনয়টা নেহার ভালোবাসা ও স্বপ্ন। সব ছেড়েছুড়ে এ অঙ্গনে জায়গা করে নেওয়ার গল্প শোনালেন। তার ভাষ্য, ‘আমি টাকার জন্য কাজ করি না, ভালোবাসা থেকে করি। বাংলাদেশ নেভিতে ছিলাম। সেটি বাদ দিয়ে চারুকলা যোগ দিই। আমি ইন্টেরিয়র করি, আর্ট ডিরেকশন করতাম। আমার আর্টিস্টিক বড় একটা ক্যারিয়ার ছিল। সব বাদ দিয়ে অভিনয়ে এসেছি। পাঁচটা বছর দিয়েছি। আমার বড় বোন রাশিয়া থাকেন। তিনি আমাকে দিনের পর দিন বলছেন, তুমি রাশিয়া আসো, মাস্টার্স করো। আমি তো যাচ্ছি না। কারণ এখানে পাঁচটি বছর দিয়েছি। কিন্তু সেই মূল্য পাইনি।’
অভিনয় ছাড়ছেন না নেহা। তবে এখন থেকে কাজ করবেন বুঝেশুনে। তার ভাষ্য, ‘এখন থেকে যারা আমাকে ওই মূল্যায়নটা করবে এবং আমার মনে হবে কাজ করে মানসিক অশান্তি হবে না আমি সেখানেই কাজ করব। তবে কোনো বুলশিট এক্সেপ্ট করব না। যখনই মনে হবে কোথাও ভুল হচ্ছে সেটা বলব। সেটা যেই হোক।’